পিতার কোলে পুত্র

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম: আজ পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মনে হয় আমরা দুবার স্বাধীন হয়েছি। একবার ১৬ ডিসেম্বর, আরেকবার ১০ জানুয়ারি। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এখন কে কী ভাবে, কার কেমন লাগে বলতে পারব না। কিন্তু মুক্ত-স্বাধীন দেশে আমার যেটা মনে হয়েছিল তা হচ্ছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অধরা। ১৬ ডিসেম্বর হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার আনন্দ সবার মধ্যে ছিল না। কেমন একটা হাহাকার, কেমন একটা হা-হুতাশ, কেমন একটা নাড়িছেঁড়া হুতাশন। কিছুতেই কোনো পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া যাচ্ছিল না। অন্যের কথা জানি না, সব সময় আমার মন কাঁদছিল পিতার জন্য। হঠাৎই জানুয়ারির ৩ বা ৪ তারিখ জাতির পিতার মুক্তির উড়ো খবরে টাঙ্গাইল কেঁপে উঠেছিল। টাঙ্গাইলের আশপাশে দেড়-দুই শ ক্যাম্প করে তখন কাদেরিয়া বাহিনী অবস্থান করছিল। কালিহাতী-সখিপুর-ভূঞাপুর-মির্জাপুর-গোপালপুর-নাগরপুর সব জায়গায়ই ঘাঁটি ছিল। ১৭-১৮ হাজার প্রত্যক্ষযোদ্ধা শিবিরে বসবাস করত। একেবারে কড়া শাসনে সেনাছাউনির মতো। ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ৮-১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকও ছিল শিবিরবাসী। তাই নিয়মাবদ্ধ অনেক ঘাঁটি ছিল। হঠাৎই রাত ৮টা-সাড়ে ৮টার দিকে চারদিকে গুলি, পুরো মুক্তিযুদ্ধে কখনো কোথাও অনুমতি ছাড়া একটা গুলিও ফোটেনি। কিন্তু সেদিন গুলি আর গুলি। কোনো অনুমতি নেই। এত গোলাগুলি কোথাও ফোন করা যাচ্ছিল না, ফোন করা গেলেও কথা শোনা যাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টাচরিত করে আনোয়ারুল আলম শহীদ, আবদুস সবুর খান বীরবিক্রম, হাবিবুর রহমান বীরবিক্রম, মেজর আবদুল হাকিম বীরপ্রতীক, এনায়েত করিম, ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান, ক্যাপ্টেন ফজলুল হক বীরপ্রতীক, মেজর গোলাম মোস্তফা বীরপ্রতীক, আবদুল গফুর বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীকসহ ২৫-৩০ জনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি গোলাগুলির অনুসন্ধানে। যে ক্যাম্পেই যাই শুধু গুলি আর গুলি। কমান্ডারকে ডেকে কঠিন তিরস্কার করে আকাশের দিকে গুলি ছোড়া বন্ধ করে সরে যেতেই আবার গুলি। এক শিবির থেকে আরেক শিবিরে ছোটাছুটি করে প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টায় গুলি নিয়ন্ত্রণে আসে। পরদিন সব কমান্ডারকে ডাকা হয়। দীর্ঘ সময় আলোচনা হয়। অনেককে তিরস্কার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে কোনো মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কখনো অমন শক্ত তিরস্কার শোনেনি। কারণ কাদেরিয়া বাহিনীতে যুদ্ধ হয়েছে, কষ্ট হয়েছে। কিন্তু রাগারাগি হয়নি। কোনো গালাগালি হয়নি। আমি খুব কঠোরভাবে এ উত্তেজনাটি চেপে রাখতে যোদ্ধাদের শিখিয়েছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম উত্তেজনা কোনো শুভলক্ষণ নয়। আর গালাগালি, রাগারাগি তো কোনো কাজের হতে পারে না। তাই চিৎকার-চেঁচামেচি, রাগারাগি ফান্দাফান্দি কাদেরিয়া বাহিনীর আশপাশে ছিল না। যেটা নতুন বছরে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ভুয়া খবরে সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কম করে ৪-৫ লাখ গুলি খরচ করা হয়েছিল। কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে, আনন্দিত হয়ে চায়না ব্যালেন্ডার সাইট ও ব্রিটিশ রকেট লঞ্চার ব্যবহার করেছিল। অনেক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক করা হয় জাতির পিতার মুক্তির সংবাদে ইচ্ছা-স্বাধীন কেউ গুলি চালাতে পারবে না। প্রতি ঘাঁটিতে একটা রাইফেল, একটা স্টেনগান, একটা এলএমজি, একটা এমজি ব্যবহার করতে পারবে। কেউ আকাশে গুলি ছুড়তে পারবে না। আকাশে গুলি ছুড়লে বুলেট ফিরে এসে কারও গায়ে লেগে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আকাশে গুলি করলেই সেই গুলি যে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, তেমন নয়। বুলেট ফিরে এসে কাউকে অবশ্য অবশ্যই আঘাত করতে পারে। তাই গুলি করতে হবে মাটি খুঁড়ে বাংকার করে সেখানে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শঙ্কা চলতেই থাকে। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের তখন কেমন যেন শুধু পিতাকে নিয়েই চিন্তা। আমাদের আর কোনো কাজ নেই। বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন, কোথায় আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন কি না তা অনেকেরই জানা ছিল না। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের খবর জানতে। আমাদের তখন যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধাও ছিল। বেশ কয়েকজনকে তখনকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রাখা হয়েছিল যেখানে বিদেশি সাংবাদিকরা গিজগিজ করছিল। অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিল আমাদের জন্য অবারিত। তাই খবর পাওয়ার খুবই সুবিধা ছিল।

অন্যদিকে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার সেনাপতি আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করলে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের জন্য যেমন বুকটা হুহু করছিল, ঠিক তেমনি আমার মা-ভাইবোনের জন্যও হৃদয় কাঁদছিল। আগস্টের ১৬ তারিখ ধলাপাড়ার মাকরাইয়ে আমার হাতে-পায়ে গুলি লাগলে আমার পরিবারকে দুই ভাগ করে ফেলেছিলাম। বাবা, বাবুল সিদ্দিকী, বেলাল সিদ্দিকী এবং আমি এক অংশ। বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী আগেই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে মা, রহিমা, শুশু, শাহানা, আজাদ, মুরাদ আরেক অংশ। যাদের ঢাকা পাঠিয়েছিলাম নারিন্দার সারাহ খালার কথা চিন্তা করে কাদেরিয়া বাহিনীর সফল চিকিৎসক কাউলজানির ডা. শাহাজাদা চৌধুরী, ড. নুরুন্নবী ও বেহুলা লখিন্দরের আবুল কাশেমকে দায়িত্ব দিয়ে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি হয়নি। বাবা ছিলেন ভারত সীমান্তের মারকার চরে। তাঁর কাজই ছিল একেওকে সাহায্য করা। আল্লাহ তাঁকে সামর্থ্যও দিয়েছিলেন। কারণ আমি বিশাল মুক্তিবাহিনীকে পরিচালনা করছিলাম। ঢাকায় এসে মায়েরও কোনো অসুবিধা হয়নি। পুরান ঢাকার নারিন্দার সারাহ খালার বাড়িতে যাওয়ার আগেই ডা. শাহাজাদা চৌধুরীর শ্বশুরবাড়ি চাষাঢ়ায় আমার মা, ভাইবোনকে উঠিয়েছিল। পরম আত্মীয়ের মতো তারা যত্ন করেছে। তাই ১৬ ডিসেম্বর হানাদারদের আত্মসমর্পণের পরপরই খালার বাড়ি নারিন্দায় গিয়েছিলাম মা এবং ভাইবোনের খবর নিতে। সেখানে গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। তারা আবার নারায়ণগঞ্জে গিয়ে বিক্রমপুরের সেলিমের সহায়তায় একটি লঞ্চে করে ধলেশ্বরী, যমুনা হয়ে টাঙ্গাইলের দিকে এগোচ্ছিল এবং স্বাধীনতার দুই দিন পর তারা টাঙ্গাইলে পৌঁছেছিল। অন্যদিকে নারিন্দায় মা-ভাইবোনদের না পেয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের খোঁজে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে গিয়েছিলাম। গেটের কাছে দাঁড়াতেই একটা ডাটসান গাড়িতে উন্মাদের মতো চারজন লোক ছুটে আসে। নেমেই জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনারা এখানে? আপনারা কী চান? বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে দেখা করবেন?’ বলেছিলাম, হ্যাঁ। ‘তারা তো এখানে থাকে না। তারা ১৯ নম্বর বাড়িতে থাকেন। চলেন আমরা আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি।’ অত বড় একটা যুদ্ধ মোকাবিলা করেছি। হাজার হাজার মানুষকে পথ দেখিয়েছি। কিন্তু খোঁজখবর না করেই চারজনের পিছে ছুটেছিলাম। বঙ্গবন্ধু পরিবার যে বাড়িতে ছিল প্রথম গাড়ি মানে ডাটসান গাড়িটি ১৯ নম্বর বাড়ির গেটে পৌঁছাতেই হানাদারদের মেশিনগান গর্জে ওঠে। সামনের গাড়ির চারজনই নীরব-নিথর হয়ে যায়। আমার গাড়ি ছিল সামনের গাড়ি থেকে ৫০-৬০ গজ পেছনে। আমার গাড়িতেও দুটি গুলি লাগে। একটি দরজায়, আরেকটি ইঞ্জিনে। আমার পেছনেও ছিল প্রায় ১৫-২০টি মুক্তিযোদ্ধা বোঝাই নানা ধরনের গাড়ি। আমরা সবাই গাড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ি। তাই কারও ক্ষতি হয়নি। অনেক চেষ্টা করে শুধু আমার গাড়িটি ফেলে রেখে পিছিয়ে এসে মিত্রবাহিনীর ঘাঁটি খোঁজার চেষ্টা করি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে ব্রিগেডিয়ার সানসিংয়ের ঘাঁটি পাই। সেখানে এক কর্নেল বঙ্গবন্ধু পরিবার তখনো হানাদারের কবলে জানালে আমাদের ব্রিগেডিয়ার সানসিংয়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন তারা নামে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেভাবেই হোক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির হানাদারদের আত্মসমর্পণ করাতে হবে। অনেক চেষ্টা করে বলেকয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বুরবক পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণ করানো হয়েছিল। কাদেরিয়া বাহিনীর পক্ষ থেকে ১৮ ডিসেম্বর পল্টনে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনসভার আহ্বান করা হয়েছিল। সে সভায় লোকসমাগম হয়েছিল প্রায় আড়াই-তিন লাখ। সেখানে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, ‘শেখ মুজিবকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি না দিলে আমরা পাকিস্তান আক্রমণ করব। এ ব্যাপারে ভারতের সহযোগিতা কামনা করছি।’ সেই সমাবেশে নারী হরণকারী লুটেরা চারজনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। তারা বাঙালি না অবাঙালি আমরা কেউ জানতাম না। তাদের অপরাধই ছিল আমাদের কাছে মূল বিবেচ্য। এ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে কলকাতা থেকে আমার নামে প্রথম গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। আবার কি বিস্ময়ের ব্যাপার, ২৪ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু যখন কাদেরিয়া বাহিনীর হাত থেকে অস্ত্র নিতে গিয়েছিলেন তখন টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে প্রায় ১০-১৫ লাখ মানুষের সামনে বলেছিলেন, ‘কাদের পল্টনে চারজনকে গুলি করেছে। যারা অশান্তি সৃষ্টি করে, যারা লুটতরাজ করে তাদের আরও এক হাজার জনকে যদি কাদের গুলি করে শাস্তি দিত তা হলেও ধন্যবাদ পেত।’ এই ছিলেন জাতির পিতা।

 

আমরা ৮ তারিখ খবর পাই বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তাঁর লন্ডন পৌঁছে যাওয়ার সংবাদ আমরা যথাসময়ে পাই। একটা আনন্দের হিল্লোল খেলে যায়। মুক্তিবাহিনীর প্রায় তিন-সাড়ে তিন শ অবস্থান থেকে একযোগে গানফায়ার শুরু হয়। প্রতিটি শিবিরে বাংকার করে মেশিনগান চালানো হয়। যেখানে যেখানে রিকোয়ার্লেস রাইফেল ছিল, আরআর ছিল সেখান থেকে গানফায়ার করা হয়। ৯, ১০ তারিখ ছিল আমাদের কাছে বাতাসে উড়ে যাওয়ার মতো দিন। কখন সূর্য উঠেছে, কখন ডুবেছে আমাদের কোনো খেয়াল ছিল না। প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধাদের সভা-সমাবেশ থাকত। কোনো দিন একটা, কোনো দিন দুইটা, তিনটা, চারটা। তখন সকাল ৭টা-৮টায় ঘর থেকে বেরোতাম। আর বাড়ি ফিরতাম রাত ১০-১১টার দিকে। যদিও আমার বাড়ি ছিল না। ৩ এপ্রিল ’৭১ পাকিস্তান হানাদাররা টাঙ্গাইলে ঢুকেই আসাদুজ্জামান খান, বদিউজ্জামান খান এবং লতিফ সিদ্দিকীর বাড়ি ধ্বংস করে দেয়। তখন আমাদের আকুরটাকুর পাড়ার পোড়া বাড়িতে টিনের ছাপড়া তুলে মা-বাবা থাকতেন অন্য ভাইবোনকে নিয়ে, পাশের ওয়াপদা ডাকবাংলোয় আমি থাকতাম। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তখন আমরা টাঙ্গাইলের পাথরাইলে পূর্বনির্ধারিত জনসভায় ছিলাম। সকালে গিয়েছিলাম কুদ্দুসনগরের শহীদ কুদ্দুসদের বাড়ি। বিকালে ছিল জনসভা। ঢাকা বেতার কেন্দ্র সারা দিন বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির ধারাবিবরণী দিচ্ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে দিল্লির পালামে এসে অবতরণ করেন। সেখানে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংসহ অসংখ্য নেতা পিতাকে পালাম বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। তাঁরা নিয়ে যান দিল্লির রামলীলা ময়দানে। সেখানে তিনি প্রথমে ইংরেজিতে, পরে লোকজন চিৎকার করায় বাংলায় বক্তৃতা করেন। কয়েক লাখ ভারতবাসী বাংলার এই অবিস্মরণীয় নেতার বক্তৃতা প্রাণভরে শোনে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়ও বঙ্গবন্ধুকে নামানোর চেষ্টা হয়েছিল। কলকাতার গড়ের মাঠে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কলকাতায় নামেননি। তাঁর সমস্ত হৃদয় জুড়ে ছিল বাংলাদেশ। তিনি ১০ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা বিমানবন্দরে নামেন। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কতটুকুই বা পথ। দুই-আড়াই কিলোমিটার। এই পথ অতিক্রম করতে আড়াই-তিন ঘণ্টা লেগেছিল। ৭ মার্চ জাতির পিতার জীবনের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। বাংলাদেশের সব মানুষের হৃদয় উজাড় করে তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে। একটা দেশের স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতার যোদ্ধাদের সামনে যা যা সমস্যা আসতে পারে তার সমাধান কোনো কিছুই সেদিন পিতার বক্তৃতায় বাদ ছিল না। সব ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি সবাই আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কতটা তীক্ষè বুদ্ধি থাকলে একজন মানুষ মুক্তির সংগ্রাম আগে বলে স্বাধীনতার সংগ্রাম পরে বলতে পারেন। তিনি জানতেন স্বাধীনতার সংগ্রাম আগে বললে মানুষের উচ্ছ্বাসে মুক্তির সংগ্রাম কেউ শুনবে না। তাই মুক্তির সংগ্রাম আগে বলে স্বাধীনতার সংগ্রাম তিনি পরে বলেছিলেন। এমন ক্ষুরধার ধীশক্তিসম্পন্ন কোনো নেতা এই ভূখন্ডে আর কখনো জন্মাবে বলে মনে হয় না।

 

আগেই বলেছি, কাদেরিয়া বাহিনীর পক্ষ থেকে ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম জনসভা করা হয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, ‘শেখ মুজিবকে মুক্তি দাও। না হলে পাকিস্তান আক্রমণ করব।’ সেই জনসভার পর থেকেই সারা দেশে আলোচনা শুরু হয়েছিল আমরা কখন বঙ্গবন্ধুকে পাব। সত্যিই যদি সে সময় বঙ্গবন্ধুকে না পেতাম তাহলে কোনোমতেই পরাজিত পাকিস্তানি ৯৬ হাজার সেনা এবং কিছু বেসামরিক লোক পাকিস্তানে ফিরতে পারত না। বঙ্গবন্ধু জীবিত ফিরে না এলে হানাদাররা যেমন ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, ২ লাখ মা-বোনের সম্মান-সম্ভ্রম নষ্ট করেছিল তেমনি স্বাধীনতার পর আরও ২-৪-১০ লাখ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী হানাদারের সহযোগিতাকারী বাংলার কুলাঙ্গার নিহত হতো। তাদের কেউ বাঁচাতে পারত না। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন। তাই অনেকেই বেঁচে গিয়েছিল।

 

১০ জানুয়ারি রাত ১১টা ঝনঝন করে ফোন বেজে ওঠে। ফোনের কাছে যে ছিল ছুটে এসে জানায়, বঙ্গবন্ধু কথা বলবেন আপনাকে চাচ্ছেন। আমরা কেউ আশা করিনি বঙ্গবন্ধুর ফোন পাব। পরদিন ১১ তারিখ ঢাকা যাব ঠিক করে ফেলেছিলাম। ছুটে গিয়ে হ্যালো বলতেই পিতার কণ্ঠ, ‘কাদের সবাইকে দেখলাম আপনাকে দেখলাম না?’ বলেছিলাম, বললে এখনই আসি। পিতা বলেছিলেন, ‘না, টাঙ্গাইল থেকে আসতে কতক্ষণ লাগবে?’ আড়াই-তিন ঘণ্টার কমে হবে না। প্রায় ২২-২৩টি সেতু ভাঙা। নেতা-পিতা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘না রে, তোকে রাতে আসতে হবে না। তুই সকালের দিকে চলে আয়। জানিস, সাংবাদিকরা তোকে নিয়ে লন্ডনে প্রশ্ন করেছিল, Who is kader Siddique? আমি বলেছি, Oh! Kader Siddique-he is my son. কাদের, আমি কি ভুল বলেছি?’ না, ভুল বলবেন কেন? আমার সব তনুমন-প্রাণ বীণার মতো বেজে উঠেছিল। কয়েক সেকেন্ড আগে যিনি ‘আপনি’ বলে তিরস্কার করেছিলেন, তিনিই সন্তানের মতো তুই বলে সম্বোধন করলেন। পরদিন সকাল ৮টা-সাড়ে ৮টায় ধানমন্ডির বাড়িতে পিতার সান্নিধ্যে গিয়েছিলাম। শ-দুই-আড়াই কৃতী মুক্তিযোদ্ধার বহর নিয়ে আমি যখন বাড়ির গেটে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে ভিতরের দিকে যাচ্ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পত্রপত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন আমাকে নিয়ে অনেক কিছু ভালোমন্দ বলেছে। তাই আমি অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই ছাত্রছাত্রীরা আমাকে গেটে দেখে ‘কাদের সিদ্দিকী, কাদের সিদ্দিকী’ বলছিল। এটা নিশ্চয়ই পিতার কানে যায়। তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ান। আমি এবং আমরা ছুটে গিয়ে পিতাকে সালাম করতে থাকি। বঙ্গবন্ধু আমাকে এক হ্যাঁচকা টানে কোলে তুলে বঙ্গমাতার দিকে ছুটে ছিলেন আর বলছিলেন ‘রেণু রেণু দেখো আমি কাকে নিয়ে এসেছি।’ বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘ওকে আর আমাকে চেনাতে হবে না। ও তোমার আগেই আমাকে সালাম করে গেছে। ১৮ ডিসেম্বর জামালকে পল্টনে নিয়ে গিয়েছিল। এর মাঝে ও অনেকবার এসেছে। আর মুক্তিযুদ্ধের আগেও তো ওরা আসত। লতিফ, কাদের, রহিমা। ওদের সঙ্গে কতবার দেখা। তাই তুমি ওকে আর দেখাবে কী!’

 

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ৫১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি

» এই সরকার ব্যর্থ হলে দেশ ব্যর্থ হবে : মির্জা ফখরুল

» স্বৈরাচার হাসিনা পালালেও তার লেজ রয়ে গেছে : তারেক রহমান

» বিচার যেন বিগত দিনের মতো না হয় : জয়নুল আবদিন ফারুক

» ঝালকাঠি থেকে ১১ রুটে বাস চলাচল বন্ধ

» অভিষেক ছাড়তে চেয়েছিলেন অভিনয়, ফেরালেন কে?

» রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেলেন সদ্য সাবেক আইজিপি ময়নুল

» ইসকন ইস্যুতে দেশি-বিদেশি ইন্ধন থাকতে পারে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

» আইনজীবী হত্যার তদন্তের নির্দেশ, দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

» ‌আমরা কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে দেব না : হাসনাত আব্দুল্লাহ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

পিতার কোলে পুত্র

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম: আজ পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মনে হয় আমরা দুবার স্বাধীন হয়েছি। একবার ১৬ ডিসেম্বর, আরেকবার ১০ জানুয়ারি। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এখন কে কী ভাবে, কার কেমন লাগে বলতে পারব না। কিন্তু মুক্ত-স্বাধীন দেশে আমার যেটা মনে হয়েছিল তা হচ্ছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অধরা। ১৬ ডিসেম্বর হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার আনন্দ সবার মধ্যে ছিল না। কেমন একটা হাহাকার, কেমন একটা হা-হুতাশ, কেমন একটা নাড়িছেঁড়া হুতাশন। কিছুতেই কোনো পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া যাচ্ছিল না। অন্যের কথা জানি না, সব সময় আমার মন কাঁদছিল পিতার জন্য। হঠাৎই জানুয়ারির ৩ বা ৪ তারিখ জাতির পিতার মুক্তির উড়ো খবরে টাঙ্গাইল কেঁপে উঠেছিল। টাঙ্গাইলের আশপাশে দেড়-দুই শ ক্যাম্প করে তখন কাদেরিয়া বাহিনী অবস্থান করছিল। কালিহাতী-সখিপুর-ভূঞাপুর-মির্জাপুর-গোপালপুর-নাগরপুর সব জায়গায়ই ঘাঁটি ছিল। ১৭-১৮ হাজার প্রত্যক্ষযোদ্ধা শিবিরে বসবাস করত। একেবারে কড়া শাসনে সেনাছাউনির মতো। ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ৮-১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকও ছিল শিবিরবাসী। তাই নিয়মাবদ্ধ অনেক ঘাঁটি ছিল। হঠাৎই রাত ৮টা-সাড়ে ৮টার দিকে চারদিকে গুলি, পুরো মুক্তিযুদ্ধে কখনো কোথাও অনুমতি ছাড়া একটা গুলিও ফোটেনি। কিন্তু সেদিন গুলি আর গুলি। কোনো অনুমতি নেই। এত গোলাগুলি কোথাও ফোন করা যাচ্ছিল না, ফোন করা গেলেও কথা শোনা যাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টাচরিত করে আনোয়ারুল আলম শহীদ, আবদুস সবুর খান বীরবিক্রম, হাবিবুর রহমান বীরবিক্রম, মেজর আবদুল হাকিম বীরপ্রতীক, এনায়েত করিম, ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান, ক্যাপ্টেন ফজলুল হক বীরপ্রতীক, মেজর গোলাম মোস্তফা বীরপ্রতীক, আবদুল গফুর বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীকসহ ২৫-৩০ জনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি গোলাগুলির অনুসন্ধানে। যে ক্যাম্পেই যাই শুধু গুলি আর গুলি। কমান্ডারকে ডেকে কঠিন তিরস্কার করে আকাশের দিকে গুলি ছোড়া বন্ধ করে সরে যেতেই আবার গুলি। এক শিবির থেকে আরেক শিবিরে ছোটাছুটি করে প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টায় গুলি নিয়ন্ত্রণে আসে। পরদিন সব কমান্ডারকে ডাকা হয়। দীর্ঘ সময় আলোচনা হয়। অনেককে তিরস্কার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে কোনো মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কখনো অমন শক্ত তিরস্কার শোনেনি। কারণ কাদেরিয়া বাহিনীতে যুদ্ধ হয়েছে, কষ্ট হয়েছে। কিন্তু রাগারাগি হয়নি। কোনো গালাগালি হয়নি। আমি খুব কঠোরভাবে এ উত্তেজনাটি চেপে রাখতে যোদ্ধাদের শিখিয়েছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম উত্তেজনা কোনো শুভলক্ষণ নয়। আর গালাগালি, রাগারাগি তো কোনো কাজের হতে পারে না। তাই চিৎকার-চেঁচামেচি, রাগারাগি ফান্দাফান্দি কাদেরিয়া বাহিনীর আশপাশে ছিল না। যেটা নতুন বছরে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ভুয়া খবরে সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কম করে ৪-৫ লাখ গুলি খরচ করা হয়েছিল। কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে, আনন্দিত হয়ে চায়না ব্যালেন্ডার সাইট ও ব্রিটিশ রকেট লঞ্চার ব্যবহার করেছিল। অনেক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক করা হয় জাতির পিতার মুক্তির সংবাদে ইচ্ছা-স্বাধীন কেউ গুলি চালাতে পারবে না। প্রতি ঘাঁটিতে একটা রাইফেল, একটা স্টেনগান, একটা এলএমজি, একটা এমজি ব্যবহার করতে পারবে। কেউ আকাশে গুলি ছুড়তে পারবে না। আকাশে গুলি ছুড়লে বুলেট ফিরে এসে কারও গায়ে লেগে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আকাশে গুলি করলেই সেই গুলি যে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, তেমন নয়। বুলেট ফিরে এসে কাউকে অবশ্য অবশ্যই আঘাত করতে পারে। তাই গুলি করতে হবে মাটি খুঁড়ে বাংকার করে সেখানে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শঙ্কা চলতেই থাকে। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের তখন কেমন যেন শুধু পিতাকে নিয়েই চিন্তা। আমাদের আর কোনো কাজ নেই। বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন, কোথায় আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন কি না তা অনেকেরই জানা ছিল না। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের খবর জানতে। আমাদের তখন যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধাও ছিল। বেশ কয়েকজনকে তখনকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রাখা হয়েছিল যেখানে বিদেশি সাংবাদিকরা গিজগিজ করছিল। অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিল আমাদের জন্য অবারিত। তাই খবর পাওয়ার খুবই সুবিধা ছিল।

অন্যদিকে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার সেনাপতি আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করলে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের জন্য যেমন বুকটা হুহু করছিল, ঠিক তেমনি আমার মা-ভাইবোনের জন্যও হৃদয় কাঁদছিল। আগস্টের ১৬ তারিখ ধলাপাড়ার মাকরাইয়ে আমার হাতে-পায়ে গুলি লাগলে আমার পরিবারকে দুই ভাগ করে ফেলেছিলাম। বাবা, বাবুল সিদ্দিকী, বেলাল সিদ্দিকী এবং আমি এক অংশ। বড়ভাই লতিফ সিদ্দিকী আগেই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে মা, রহিমা, শুশু, শাহানা, আজাদ, মুরাদ আরেক অংশ। যাদের ঢাকা পাঠিয়েছিলাম নারিন্দার সারাহ খালার কথা চিন্তা করে কাদেরিয়া বাহিনীর সফল চিকিৎসক কাউলজানির ডা. শাহাজাদা চৌধুরী, ড. নুরুন্নবী ও বেহুলা লখিন্দরের আবুল কাশেমকে দায়িত্ব দিয়ে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি হয়নি। বাবা ছিলেন ভারত সীমান্তের মারকার চরে। তাঁর কাজই ছিল একেওকে সাহায্য করা। আল্লাহ তাঁকে সামর্থ্যও দিয়েছিলেন। কারণ আমি বিশাল মুক্তিবাহিনীকে পরিচালনা করছিলাম। ঢাকায় এসে মায়েরও কোনো অসুবিধা হয়নি। পুরান ঢাকার নারিন্দার সারাহ খালার বাড়িতে যাওয়ার আগেই ডা. শাহাজাদা চৌধুরীর শ্বশুরবাড়ি চাষাঢ়ায় আমার মা, ভাইবোনকে উঠিয়েছিল। পরম আত্মীয়ের মতো তারা যত্ন করেছে। তাই ১৬ ডিসেম্বর হানাদারদের আত্মসমর্পণের পরপরই খালার বাড়ি নারিন্দায় গিয়েছিলাম মা এবং ভাইবোনের খবর নিতে। সেখানে গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। তারা আবার নারায়ণগঞ্জে গিয়ে বিক্রমপুরের সেলিমের সহায়তায় একটি লঞ্চে করে ধলেশ্বরী, যমুনা হয়ে টাঙ্গাইলের দিকে এগোচ্ছিল এবং স্বাধীনতার দুই দিন পর তারা টাঙ্গাইলে পৌঁছেছিল। অন্যদিকে নারিন্দায় মা-ভাইবোনদের না পেয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের খোঁজে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে গিয়েছিলাম। গেটের কাছে দাঁড়াতেই একটা ডাটসান গাড়িতে উন্মাদের মতো চারজন লোক ছুটে আসে। নেমেই জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনারা এখানে? আপনারা কী চান? বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে দেখা করবেন?’ বলেছিলাম, হ্যাঁ। ‘তারা তো এখানে থাকে না। তারা ১৯ নম্বর বাড়িতে থাকেন। চলেন আমরা আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি।’ অত বড় একটা যুদ্ধ মোকাবিলা করেছি। হাজার হাজার মানুষকে পথ দেখিয়েছি। কিন্তু খোঁজখবর না করেই চারজনের পিছে ছুটেছিলাম। বঙ্গবন্ধু পরিবার যে বাড়িতে ছিল প্রথম গাড়ি মানে ডাটসান গাড়িটি ১৯ নম্বর বাড়ির গেটে পৌঁছাতেই হানাদারদের মেশিনগান গর্জে ওঠে। সামনের গাড়ির চারজনই নীরব-নিথর হয়ে যায়। আমার গাড়ি ছিল সামনের গাড়ি থেকে ৫০-৬০ গজ পেছনে। আমার গাড়িতেও দুটি গুলি লাগে। একটি দরজায়, আরেকটি ইঞ্জিনে। আমার পেছনেও ছিল প্রায় ১৫-২০টি মুক্তিযোদ্ধা বোঝাই নানা ধরনের গাড়ি। আমরা সবাই গাড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ি। তাই কারও ক্ষতি হয়নি। অনেক চেষ্টা করে শুধু আমার গাড়িটি ফেলে রেখে পিছিয়ে এসে মিত্রবাহিনীর ঘাঁটি খোঁজার চেষ্টা করি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে ব্রিগেডিয়ার সানসিংয়ের ঘাঁটি পাই। সেখানে এক কর্নেল বঙ্গবন্ধু পরিবার তখনো হানাদারের কবলে জানালে আমাদের ব্রিগেডিয়ার সানসিংয়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন তারা নামে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেভাবেই হোক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির হানাদারদের আত্মসমর্পণ করাতে হবে। অনেক চেষ্টা করে বলেকয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বুরবক পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণ করানো হয়েছিল। কাদেরিয়া বাহিনীর পক্ষ থেকে ১৮ ডিসেম্বর পল্টনে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনসভার আহ্বান করা হয়েছিল। সে সভায় লোকসমাগম হয়েছিল প্রায় আড়াই-তিন লাখ। সেখানে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, ‘শেখ মুজিবকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি না দিলে আমরা পাকিস্তান আক্রমণ করব। এ ব্যাপারে ভারতের সহযোগিতা কামনা করছি।’ সেই সমাবেশে নারী হরণকারী লুটেরা চারজনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। তারা বাঙালি না অবাঙালি আমরা কেউ জানতাম না। তাদের অপরাধই ছিল আমাদের কাছে মূল বিবেচ্য। এ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে কলকাতা থেকে আমার নামে প্রথম গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। আবার কি বিস্ময়ের ব্যাপার, ২৪ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু যখন কাদেরিয়া বাহিনীর হাত থেকে অস্ত্র নিতে গিয়েছিলেন তখন টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে প্রায় ১০-১৫ লাখ মানুষের সামনে বলেছিলেন, ‘কাদের পল্টনে চারজনকে গুলি করেছে। যারা অশান্তি সৃষ্টি করে, যারা লুটতরাজ করে তাদের আরও এক হাজার জনকে যদি কাদের গুলি করে শাস্তি দিত তা হলেও ধন্যবাদ পেত।’ এই ছিলেন জাতির পিতা।

 

আমরা ৮ তারিখ খবর পাই বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তাঁর লন্ডন পৌঁছে যাওয়ার সংবাদ আমরা যথাসময়ে পাই। একটা আনন্দের হিল্লোল খেলে যায়। মুক্তিবাহিনীর প্রায় তিন-সাড়ে তিন শ অবস্থান থেকে একযোগে গানফায়ার শুরু হয়। প্রতিটি শিবিরে বাংকার করে মেশিনগান চালানো হয়। যেখানে যেখানে রিকোয়ার্লেস রাইফেল ছিল, আরআর ছিল সেখান থেকে গানফায়ার করা হয়। ৯, ১০ তারিখ ছিল আমাদের কাছে বাতাসে উড়ে যাওয়ার মতো দিন। কখন সূর্য উঠেছে, কখন ডুবেছে আমাদের কোনো খেয়াল ছিল না। প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধাদের সভা-সমাবেশ থাকত। কোনো দিন একটা, কোনো দিন দুইটা, তিনটা, চারটা। তখন সকাল ৭টা-৮টায় ঘর থেকে বেরোতাম। আর বাড়ি ফিরতাম রাত ১০-১১টার দিকে। যদিও আমার বাড়ি ছিল না। ৩ এপ্রিল ’৭১ পাকিস্তান হানাদাররা টাঙ্গাইলে ঢুকেই আসাদুজ্জামান খান, বদিউজ্জামান খান এবং লতিফ সিদ্দিকীর বাড়ি ধ্বংস করে দেয়। তখন আমাদের আকুরটাকুর পাড়ার পোড়া বাড়িতে টিনের ছাপড়া তুলে মা-বাবা থাকতেন অন্য ভাইবোনকে নিয়ে, পাশের ওয়াপদা ডাকবাংলোয় আমি থাকতাম। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তখন আমরা টাঙ্গাইলের পাথরাইলে পূর্বনির্ধারিত জনসভায় ছিলাম। সকালে গিয়েছিলাম কুদ্দুসনগরের শহীদ কুদ্দুসদের বাড়ি। বিকালে ছিল জনসভা। ঢাকা বেতার কেন্দ্র সারা দিন বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির ধারাবিবরণী দিচ্ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে দিল্লির পালামে এসে অবতরণ করেন। সেখানে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংসহ অসংখ্য নেতা পিতাকে পালাম বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। তাঁরা নিয়ে যান দিল্লির রামলীলা ময়দানে। সেখানে তিনি প্রথমে ইংরেজিতে, পরে লোকজন চিৎকার করায় বাংলায় বক্তৃতা করেন। কয়েক লাখ ভারতবাসী বাংলার এই অবিস্মরণীয় নেতার বক্তৃতা প্রাণভরে শোনে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়ও বঙ্গবন্ধুকে নামানোর চেষ্টা হয়েছিল। কলকাতার গড়ের মাঠে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কলকাতায় নামেননি। তাঁর সমস্ত হৃদয় জুড়ে ছিল বাংলাদেশ। তিনি ১০ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা বিমানবন্দরে নামেন। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কতটুকুই বা পথ। দুই-আড়াই কিলোমিটার। এই পথ অতিক্রম করতে আড়াই-তিন ঘণ্টা লেগেছিল। ৭ মার্চ জাতির পিতার জীবনের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। বাংলাদেশের সব মানুষের হৃদয় উজাড় করে তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে। একটা দেশের স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতার যোদ্ধাদের সামনে যা যা সমস্যা আসতে পারে তার সমাধান কোনো কিছুই সেদিন পিতার বক্তৃতায় বাদ ছিল না। সব ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি সবাই আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কতটা তীক্ষè বুদ্ধি থাকলে একজন মানুষ মুক্তির সংগ্রাম আগে বলে স্বাধীনতার সংগ্রাম পরে বলতে পারেন। তিনি জানতেন স্বাধীনতার সংগ্রাম আগে বললে মানুষের উচ্ছ্বাসে মুক্তির সংগ্রাম কেউ শুনবে না। তাই মুক্তির সংগ্রাম আগে বলে স্বাধীনতার সংগ্রাম তিনি পরে বলেছিলেন। এমন ক্ষুরধার ধীশক্তিসম্পন্ন কোনো নেতা এই ভূখন্ডে আর কখনো জন্মাবে বলে মনে হয় না।

 

আগেই বলেছি, কাদেরিয়া বাহিনীর পক্ষ থেকে ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম জনসভা করা হয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, ‘শেখ মুজিবকে মুক্তি দাও। না হলে পাকিস্তান আক্রমণ করব।’ সেই জনসভার পর থেকেই সারা দেশে আলোচনা শুরু হয়েছিল আমরা কখন বঙ্গবন্ধুকে পাব। সত্যিই যদি সে সময় বঙ্গবন্ধুকে না পেতাম তাহলে কোনোমতেই পরাজিত পাকিস্তানি ৯৬ হাজার সেনা এবং কিছু বেসামরিক লোক পাকিস্তানে ফিরতে পারত না। বঙ্গবন্ধু জীবিত ফিরে না এলে হানাদাররা যেমন ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, ২ লাখ মা-বোনের সম্মান-সম্ভ্রম নষ্ট করেছিল তেমনি স্বাধীনতার পর আরও ২-৪-১০ লাখ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী হানাদারের সহযোগিতাকারী বাংলার কুলাঙ্গার নিহত হতো। তাদের কেউ বাঁচাতে পারত না। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন। তাই অনেকেই বেঁচে গিয়েছিল।

 

১০ জানুয়ারি রাত ১১টা ঝনঝন করে ফোন বেজে ওঠে। ফোনের কাছে যে ছিল ছুটে এসে জানায়, বঙ্গবন্ধু কথা বলবেন আপনাকে চাচ্ছেন। আমরা কেউ আশা করিনি বঙ্গবন্ধুর ফোন পাব। পরদিন ১১ তারিখ ঢাকা যাব ঠিক করে ফেলেছিলাম। ছুটে গিয়ে হ্যালো বলতেই পিতার কণ্ঠ, ‘কাদের সবাইকে দেখলাম আপনাকে দেখলাম না?’ বলেছিলাম, বললে এখনই আসি। পিতা বলেছিলেন, ‘না, টাঙ্গাইল থেকে আসতে কতক্ষণ লাগবে?’ আড়াই-তিন ঘণ্টার কমে হবে না। প্রায় ২২-২৩টি সেতু ভাঙা। নেতা-পিতা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘না রে, তোকে রাতে আসতে হবে না। তুই সকালের দিকে চলে আয়। জানিস, সাংবাদিকরা তোকে নিয়ে লন্ডনে প্রশ্ন করেছিল, Who is kader Siddique? আমি বলেছি, Oh! Kader Siddique-he is my son. কাদের, আমি কি ভুল বলেছি?’ না, ভুল বলবেন কেন? আমার সব তনুমন-প্রাণ বীণার মতো বেজে উঠেছিল। কয়েক সেকেন্ড আগে যিনি ‘আপনি’ বলে তিরস্কার করেছিলেন, তিনিই সন্তানের মতো তুই বলে সম্বোধন করলেন। পরদিন সকাল ৮টা-সাড়ে ৮টায় ধানমন্ডির বাড়িতে পিতার সান্নিধ্যে গিয়েছিলাম। শ-দুই-আড়াই কৃতী মুক্তিযোদ্ধার বহর নিয়ে আমি যখন বাড়ির গেটে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে ভিতরের দিকে যাচ্ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পত্রপত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন আমাকে নিয়ে অনেক কিছু ভালোমন্দ বলেছে। তাই আমি অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই ছাত্রছাত্রীরা আমাকে গেটে দেখে ‘কাদের সিদ্দিকী, কাদের সিদ্দিকী’ বলছিল। এটা নিশ্চয়ই পিতার কানে যায়। তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ান। আমি এবং আমরা ছুটে গিয়ে পিতাকে সালাম করতে থাকি। বঙ্গবন্ধু আমাকে এক হ্যাঁচকা টানে কোলে তুলে বঙ্গমাতার দিকে ছুটে ছিলেন আর বলছিলেন ‘রেণু রেণু দেখো আমি কাকে নিয়ে এসেছি।’ বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘ওকে আর আমাকে চেনাতে হবে না। ও তোমার আগেই আমাকে সালাম করে গেছে। ১৮ ডিসেম্বর জামালকে পল্টনে নিয়ে গিয়েছিল। এর মাঝে ও অনেকবার এসেছে। আর মুক্তিযুদ্ধের আগেও তো ওরা আসত। লতিফ, কাদের, রহিমা। ওদের সঙ্গে কতবার দেখা। তাই তুমি ওকে আর দেখাবে কী!’

 

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com